মেডিটেশন , যোগ অভ্যাস এর মতো তন্ত্র সাধনাও শারিরীক ও মানসিক ক্রিয়া। এছাড়া তন্ত্র কে যোগ শাস্ত্রের একটি ভাগ “তন্ত্র যোগ” বলা হয়। তন্ত্র- ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু গভীর তার অন্তর্নিহিত অর্থ। তন্ত্র হল এক বৃহৎ ও অতিপ্রাচীন গুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় বিষয়। মুক্ত বিশ্বকোষে বলা আছে, তন্ত্র হিন্দুসমাজে প্রচলিত ঈশ্বর উপাসনার একটি পথবিশেষ। শিব ও মহাশক্তির উপাসনা সংক্রান্ত শাস্ত্রগুলিকেও তন্ত্র সাধনা নামে অভিহিত করা হয়। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, এই মহাবিশ্ব হল শিব ও মহাশক্তির দিব্যলীলা। তন্ত্রে যেসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতি-নীতির বর্ণনা রয়েছে তার উদ্দেশ্যই হল মানুষকে অজ্ঞানতা ও পুনর্জন্মের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া।। মূলত বৌদ্ধধর্মের হাত ধরেই পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে এই তন্ত্রশাস্ত্রটি। তন্ত্র ভারতের অতিপ্রাচীন এবং গুরু পরম্পরার একটি গুপ্ত বিদ্যা। প্রাচীন ভারত থেকে বহু মূল্যবান পুঁথি চীনা পরিব্রাজকরা তাঁদের দেশে নিয়ে চলে গেছেন। এটি গুরু পরম্পরা বিদ্যা বলে প্রকৃত গুরুর খোঁজ করতে হয়। দীক্ষা ছাড়া এ শাস্ত্র সম্পর্কে সহজে কেউ কাউকে কিছু ব্যক্ত করেন না।
তন্ত্র সর্ম্পকে একটি ইউরোপিয় সূত্র লিখেছে,
" The word "tantra" is derived from the combination of two words "tattva" and "mantra". "Tattva" means the science of cosmic principles, while "mantra" refers to the science of mystic sound and vibrations. Tantra therefore is the application of cosmic sciences with a view to attain spiritual ascendancy. In another sense, tantra also means the scripture by which the light of knowledge is spread ."
তন্ত্র ক্ষমতা ব্যবহারের দ্বারা যোগী ও সিধ্য পুরুষেরা দেবতার মূর্তি মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে শক্তির আবদ্ধিকরণ করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষমতার সিদ্ধি লাভের জন্য ব্যবহার করে থাকেন।
খুব অবাক করা বিষয় হল কিছু বিশেষ প্রকৃতির তন্ত্র ব্যবহার করে মুনি ঋষিরা কয়েক হাজার বছর দীর্ঘ আয়ু লাভ করতে সক্ষম ছিলেন। কিছু তন্ত্র ক্রিয়ার সাহায্যে ঋষিরা শূন্যে ভাসমান অবস্থায বিনা জল আহার গ্রহণ করে বহু দিন থাকতে সক্ষম ।
আবার কিছু যোগীরা তন্ত্রের মন্ত্রর বলের দ্বারা আত্মজ্ঞানের চরম সীমায় পৌছেতে পেরেছেন। এছাড়াও তন্ত্র শক্তির ব্যবহার মাধ্যমে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির আহ্বান, বিভিন্ন সিদ্ধিলাভ ইত্যাদী।
তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। তার কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মা বা প্রাকৃতি কে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে ভজনা করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, পূজা করতে চায়।
পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে। চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী দূর্গা- কালী- বাসুলী - তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন আগেই অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- শক্তি দেবীর সাধনা করে "শিবত্ব" লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।
তন্ত্র সাধনায় সাধক সৃষ্টির রহস্য জেনে পরমানন্দ অনুভব করে । চৈতন্যময়ী প্রকৃতিকে তুষ্ঠ করতেই পূজা করা হয়; যাতে পূজারী কিংবা ভক্তের জীবন আনন্দময়, কল্যাণময় হয়ে ওঠে। তন্ত্র হচ্ছে দর্শন বা তত্ত্ব। আর পূজা হচ্ছে পদ্ধতি। পূজার উপচার বা উপকরণ নিষাদরা তাদের নিজস্ব পরিবেশ থেকেই সংগ্রহ করেছিল। পরবর্তীকালে বাংলায় তাদের এই ধারণার (প্রকৃতি কে 'চৈতন্যময়ী' বলে মনে করে দেবীরূপে ভজনা করা) বিবর্তিত হয়েছিল। এবং এই নারীকেন্দ্রিক তান্ত্রিক ধারণাটি পল্লবিত হয়েছিল।
তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, প্র্যাকটিস। তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল
এখানে মনে রাখতে হবে, এই গুহ্যতন্ত্রসাধনা ষোড়শ শতক পর্যন্ত এক বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে বিদেশী মুসলমান রাজশক্তির নিষ্পেষণে যখন মূলস্রোতের ব্রাহ্মণ্য পূজা-আরাধনা প্রকাশ্যে, সমারোহ সহকারে উদযাপন করার পথে অন্তরায় দেখা দিল তখন উচ্চকোটীর বিপর্যস্ত ব্রাহ্মণ্যধর্ম শরণ নিয়েছিল অনার্য কৌম সমাজের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা দেবী প্যান্থিয়নের আশ্রয়ে। এই সময় থেকেই তন্ত্রশাস্ত্র পূর্বতন অসংগঠিত রূপ থেকে ব্রাহ্মণ্যমনীষার যোগদানের ফলে এক বিস্তৃত স্ট্রাকচার্ড মাত্রা পেয়ে ছিল।
বৌদ্ধতন্ত্র ও সনাতনধর্মীয় তন্ত্রের মধ্যে বস্তুত কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভেদ নেই। আসলে সেভাবে দেখলে তন্ত্র কোনও ধর্মীয় মতবাদ নয়, তন্ত্র এক সাধনপদ্ধতি মাত্র। মনুষ্যদেহকে এক যন্ত্রস্বরূপ বিচার করে সেই সূত্রে এক গুহ্যসাধনপদ্ধতিকেই তন্ত্র বলে। এই সাধনপদ্ধতিতে অনুগামীদের বিভিন্ন দেবীর নামে দীক্ষা নিতে হয়। বেছে নেবার মতো অসংখ্য দেবী থাকলেও আমাদের দেশে শাক্তরা জগদ্ধাত্রী মন্ত্রেই অধিক দীক্ষিত হন। তারা, অন্নপূর্ণা, ত্রিপুরা ও ভুবনেশ্বরী মন্ত্রে দীক্ষিত শাক্তদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম।
তন্ত্রসাধনার মূল স্রোতটি যে আচারপদ্ধতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, তা হলো পঞ্চ ম-কার ক্রিয়া। এই পদ্ধতিটি নিয়ে আবহমানকাল ধরে নানা ধরনের পরস্পর বিপ্রতীপ মতামত প্রচলিত রয়েছে। বহু বছর আগে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবার উপক্রমনিকা হিসেবে একটি কৈফিয়ৎ যেমন ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, "...ভারত-প্রচলিত তান্ত্রিক উপাসনার প্রকৃত মর্ম ও পঞ্চ ম-কারের মূল উদ্দেশ্য আমাদের জ্ঞানে যতদূর উদ্বোধ হইয়াছে এবং ইহার আধ্যাত্মিক-তত্ত্ব যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে..." ইত্যাদি। অর্থাৎ এই ব্যাখ্যাটির প্রামাণ্যতা নির্ভর করছে দু'টি বিষয়ের উপর, 'আমাদের জ্ঞান' ও 'যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে'। এ বিষয়ে সাক্ষী মানা হয়েছে 'আগমসার' নামের একটি প্রাচীন গ্রন্থের। এই গ্রন্থে প্রথম-ম, অর্থাৎ 'মদ্য' সাধন বিষয়ে বলা হয়েছে, "সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে। পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ"।।
তাৎপর্যঃ- "হে পার্বতি! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক"। মাংসসাধনা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, "মা, রসনা শব্দের নামান্তর, বাক্য তদংশভূত; যে ব্যক্তি সতত উহা ভক্ষণ করে, তাহাকেই মাংসসাধক বলা যায়। মাংসসাধক ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে বাক্যসংযমী মৌনাবলম্বী যোগী"
মৎসসাধনার তাৎপর্য আরও গূঢ় ও প্রতীকী। "গঙ্গা-যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য সতত চরিতেছে, যে ব্যক্তি এই দুইটি মৎস্য ভোজন করে, তাহার নাম মৎস্যসাধক। আধ্যাত্মিক মর্ম গঙ্গা ও যমুনা, ইড়া ও পিঙ্গলা; এই উভয়ের মধ্যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস, তাহারাই দুইটি মৎস্য, যে ব্যক্তি এই মৎস্য ভক্ষণ করেন, অর্থাৎ প্রাণারামসাধক শ্বাস-প্রশ্বাস, রোধ করিয়া কুম্ভকের পুষ্টিসাধন করেন, তাঁহাকেই মৎস্যসাধক বলা যায়"। মুদ্রাসাধনা এরকম, "...শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্মে মুদ্রিত কর্ণিকাভ্যন্তরে শুদ্ধ পারদতুল্য আত্মার অবস্থিতি, যদিও ইহার তেজঃ কোটিসূর্য্যসদৃশ, কিন্তু স্নিগ্ধতায় ইনি কোটি চন্দ্রতুল্য। এই পরম পদার্থ অতিশয় মনোহর এবং কুন্ডলিনী শক্তি সমন্বিত, যাঁহার এরূপ জ্ঞানের উদয় হয়, তিনিই প্রকৃত মুদ্রাসাধক হইতে পারেন"। মৈথুনতত্ত্ব সম্বন্ধে 'অতি জটিল' বিশেষণ আরোপ করা হয়েছে আগমসার গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে, মৈথুনসাধক পরমযোগী। কারণ তাঁরা "বায়ুরূপ লিঙ্গকে শূন্যরূপ যোনিতে প্রবেশ করাইয়া কুম্ভকরূপ রমণে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন"। আবার অন্য ঘরানার তন্ত্রে বলা হচ্ছে, "মৈথুনব্যাপার সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ, ইহা পরমতত্ত্ব বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে। মৈথুন ক্রিয়াতে সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং তাহা হইলে সুদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে"।
ইতরজন ও নারীজাতি এই সব শাস্ত্র প্রণয়নের সময় একই ধরনের সম্মান(?) লাভ করত। সাধনসঙ্গিনী নির্বাচনের যে প্রথাপ্রকরণ এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, সেখানে নারীকে এক ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বোধ হতে পারে। নামে নারীই 'শক্তি', কিন্তু শক্তি সাধনের ষটকর্মে সাধনসঙ্গিনীর যে সব লক্ষণ নির্দেশ করা হয়েছে, তার থেকে সম্মাননা বা অবমাননার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু উল্লেখ করা যায়। যেমন, সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পদ্মিনী নারী শান্তিদায়িনী। সে হবে গৌরাঙ্গী, দীর্ঘকেশী, সর্বদা অমৃতভাষিণী ও রক্তনেত্রা। শঙ্খিণী নারী হয় মন্ত্রসিদ্ধকারী। সে হবে দীর্ঘাঙ্গী এবং নিখিল জনরঞ্জনকারিণী। যে নারী নাগিনী গোত্রের, তার লক্ষণ হলো শূদ্রতুল্যদেহধারিণী, নাতিখর্বা, নাতিদীর্ঘ, দীর্ঘকেশী, মধ্যপুষ্টা ও মৃদুভাষিণী। এরপর কৃষ্ণাঙ্গী, কৃশাঙ্গী, দন্তুরা, মদতাপিতা, হ্রস্বকেশী, দীর্ঘঘোণা, নিরন্তর নিষ্ঠুরবাদিনী, সদাক্রুদ্ধা, দীর্ঘদেহা, মহাবাবিনী, নির্লজ্জা, হাস্যহীনা, নিদ্রালু ও বহুভক্ষিণী নারীকে ডাকিনী বলা হয়।
শাক্তদের মধ্যে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের নাম পশ্বাচারী ও বীরাচারী। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল প্রভেদ হচ্ছে বীরাচারে পঞ্চ-ম কারের প্রচলন আছে, পশ্বাচারে তা নেই। কুলার্ণবতন্ত্রে এই দু' প্রকার আচারকে আবার সাত ভাগ করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বেদাচার উত্তম (এই বেদাচারের সঙ্গে বৈদিক আচারের কোনও সম্পর্ক নেই), বেদাচারের থেকে বৈষ্ণবাচার উত্তম, বৈষ্ণবাচার থেকে শৈবাচার উত্তম, শৈবাচার থেকে দক্ষিণাচার উত্তম, দক্ষিণাচার থেকে বামাচার উত্তম, বামাচার থেকে সিদ্ধান্তাচার উত্তম, সিদ্ধান্তাচারের চেয়ে কৌলাচার উত্তম। কৌলাচারের চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই ("...রামপ্রসাদ বলে নিদানকালে পতিত হবি কুল ছাড়িলে বা মন ভুলো না কথার ছলে...", এখানে 'কুল' শব্দ দ্ব্যর্থবোধক। তা বংশসম্প্রদায় ও কৌলাচারের প্রতি আনুগত্য দুইই বোঝায়)।
বিভিন্ন দেবতার যেমন নিজস্ব বিশেষ বীজমন্ত্র আছে, বিভিন্ন তান্ত্রিক ক্রিয়ারও বিশেষ বীজ আছে। কালিকার বীজ একাক্ষর, তারার বীজ ত্র্যক্ষর এবং বজ্রবৈরেচনীর বীজ একাদশাক্ষর। যোগিনীতন্ত্রে এই কথা শিবের উক্তিতে দেওয়া হয়েছে। দেবীর এই তিন রূপের মধ্যে তারা ও বজ্রবৈরেচনী বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী। পূর্ণাভিষেকের সময় স্বয়ম্ভূ-কুসুমাদির প্রতি যে শুদ্ধিমন্ত্র উচ্চারিত হয় তা এরকম, "প্লূং ম্লূং স্লূং শ্লূং স্বাহা"। আবার ব্রহ্মশাপ বিমোচন মন্ত্র, শুক্রশাপ বিমোচন মন্ত্র বা কৃষ্ণশাপ বিমোচন মন্ত্র মদ্যের প্রতি উৎসর্গিত হয়। এই সব শুদ্ধি মন্ত্র বা উৎসর্গ মন্ত্রে যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তা এরকম। 'খপুষ্প' মানে রজস্বলা স্ত্রীলোকের রজ, স্বয়ম্ভূ পুষ্প বা স্বয়ম্ভূ কুসুম মানে স্ত্রীলোকের প্রথম রজ ("...যত বিষয় মধু তুচ্ছ হল, কামাদিকুসুম সকলে... কমলাকান্ত), কুন্ডপুষ্প মানে সধবা স্ত্রীলোকের রজ, গোলকপুষ্প মানে বিধবা স্ত্রীলোকের রজ এবং বজ্রপুষ্প মানে চন্ডালীর রজ (তন্ত্রসাধনায় এই 'চন্ডালী' নারীর বিশেষ কদর আছে)। এই লক্ষণটি তন্ত্রচর্চায় ইতরযানী স্বীকৃতির নিদর্শন। এই সব 'পুষ্প' বামাচারী তন্ত্র সাধনার জরুরি উপকরণ। বাউলচর্যাতেও আমরা এজাতীয় পদ্ধতির প্রচলন দেখতে পাই।
যে কোন তন্ত্র ক্রিয়ার জন্য নিজের শরীর ও মনকে উপর চরম নিয়ন্ত্রণ একান্ত প্রয়োজন।
কারণ তন্ত্র বিদ্যা নিজের প্রাণ শক্তির উপর নির্ভরকারি অভন্তরীন প্রক্রিয়া। এই ক্রিয়ার বেশির ভাগটাই মন্ত্রের আকার গঠিত এবং এর সাথে যুক্ত হয় প্রবল কল্পনা শক্তি, ও নির্দিষ্ট শক্তিকে অবধ্য করি বিশেষ যন্ত্রম স্স্থাপন ক্রিয়া। এই তিনটি জিনিসের একত্রে সম্পুর্ন হয় তন্ত্র সাধনা প্রণালী।
এছাড়াও তন্ত্র বিদ্যা নিজের প্রাণ শক্তির উপর নির্ভরকারি প্রক্রিয়া। এই কারনে যে কোন প্রকার তন্ত্র সাধনার করা হোক না কেন প্রতিটি তন্ত্র ক্ষেত্রেই প্রয়োজন প্রাণ বা প্র্রান শক্তির ধারণ-করি দ্রবাদী, যেমন - সরষে, তিল, তাজা ফুল, জীবন্ত পশু ইত্যাদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত।
তাই তন্ত্র কোন সাধারণ ক্রিয়া নয় তাই তন্ত্র শিক্ষা নিতে তন্ত্র সিদ্ধ গুরুর প্রয়োজন, বীনা জ্ঞানে তন্ত্র সাধনার অর্থ হল মৃত্যু।
তন্ত্র ক্রিয়া কে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, প্রথম হল আভ্যন্তরীণ যেখানে সমস্থ ক্রিয়া শরীরের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং দ্বিতীয় হল বাহ্যিক প্রক্রিয়া যেখানে নানা আচার অনুষ্ঠান ক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার।
এই দুই ভাগের ভিত্তি করে ভারতে কয়েক হাজার প্রকৃতির তন্ত্র সাধনা প্রণালী জন্ম যা ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এছাড়াও বহু প্রকৃতির তন্ত্র সাধন প্রণালী সম্পুর্ন গোপন ও গুরু শিষ্য পরম্পরায় লাভ হয়ে থাকে, যার লিখিত কোন পুথিপত্র নেই।
সব কিছুর মধ্যেও পরিচিত কিছু তন্ত্র প্রণালীর নাম হল কালভৈরব তন্ত্র, কুমারী তন্ত, কুণ্ডলিনী তন্ত্র, বিশুধি তন্ত্র, শৈব তন্ত্র, শাক্ত তন্ত্র, সূর্য তন্ত্র, কামধেনু তন্ত্র, নির্বান তন্ত্র, কামখা তন্ত্র, তারা তন্ত্র, কুল তন্ত্র, অভয় তন্ত্র, যোগিনী তন্ত্র ইত্যাদি।
এছাড়া আমাদের অথর্ববেদ,পুষ্করা সংহিতা, পদ্ম সংহিতা, ভৈরব সংহিতা, গুপ্ত তন্ত্র লিপি, নারদীয় সংহিতা বহু গ্রন্থ থেকে বহু তন্ত্র রীতি উল্লেখ পাওয়া যায়।
অবাক করা বিষয় হল আমরা নিজের অজান্তে প্রতিদিন বহু কাজ করে থাকি যা সম্পুর্ন রূপে তন্ত্র এর উদাহরণ হল: ঈশ্বর ভক্তি, মানুষের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও প্রেম, ভালবাসা ইত্যাদী।
শিষ্যের দীক্ষাকালে গুরু বীজমন্ত্র উপদেশ দেন। এই বীজমন্ত্র বিভিন্ন ইষ্ট দেবীর জন্য পৃথক হয়। এই বীজমন্ত্রগুলি অতীব গুহ্য তাই তন্ত্রকারেরা তাদের গোপন রাখার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ও তার নতুন অর্থ সৃষ্টি করেছেন। এই সব শব্দের যে সব অর্থ করা হয় তা শুধুমাত্র তন্ত্রশাস্ত্রে অধিকারী ব্যক্তিরাই উদ্ধার করতে পারেন। একে আদিম ক্ল্যাসিফায়েড কোডিং প্রসেসও বলা যায়।
এক আধটা উদাহরণ দিই। 'কালীবীজ' মন্ত্র, 'বর্গাদ্যং বর্ণহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম'। এখানে 'বর্গাদ্য' শব্দের প্রতীক হচ্ছে 'ক', 'বর্ণহি' শব্দের 'র', 'রতি' শব্দে 'ঈ' এবং তাতে বিন্দু যুক্ত। সব মিলিয়ে যে প্রতীকী শব্দটি তৈরি হলো তা হচ্ছে 'ক্রীং'। এইভাবে 'ভুবনেশ্বরী বীজ' 'হ্রীং', 'লক্ষ্মীবীজ' 'শ্রীং'। যৌগিক বীজও আছে, যেমন 'তারাবীজ' 'হ্রীং স্ত্রীং হূ ফট' বা 'দুর্গাবীজ' 'ওঁ হ্রীং দূং দুর্গয়ৈ নমঃ'। এই তালিকাটি অতি দীর্ঘ ও এখানে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এছাড়া এমন কিছু বীজ আছে যেগুলি বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।
হিন্দু শাস্ত্রে 'গ্রহণ' নিয়ে অনেক বিধি-নিষেধ প্রচলিত থাকলেও তান্ত্রিক মতে, তান্ত্রিক সাধনার যাবতীয় সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত সময় চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ। সমস্ত তান্ত্রিক তাঁদের মন্ত্র সাধনা এবং গুপ্ত সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য বছর ভর গ্রহণের অপেক্ষায় থাকেন। তন্ত্র শাস্ত্রে এমন কিছু সাধনার উল্লেখ আছে, যাতে সিদ্ধি লাভ করতে গেলে প্রচুর পরিশ্রম আর কঠোর সাধনা করতে হয়। গ্রহণের সময় সেই সাধনায় বসলে অতি সহজে এবং অল্প সময়ে সাফল্য আসে। এবার জেনে নিন, কী কী সাফল্য পাওয়া যেতে পারে গ্রহণকাল থেকে--- চাকরি বা ব্যবসায় উন্নতি: চাইলে গ্রহণের আগে স্নান সেরে পুজোর ঘরে শ্রীযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। যন্ত্রের সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিন। গ্রহণ শুরু হওয়ার পর পঞ্চোপচারে শ্রীযন্ত্রের পুজো করুন। গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই মন্ত্র জপ করতে থাকুন: 'ওঁ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলে কমলালয়ে প্রসীদ প্রসীদ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলভ্যে নমঃ'। বাড়িতে আলাদা করে কোনও ঠাকুরঘর না থাকলে যে কোনও শান্ত, পবিত্র স্থানে যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে পারেন।
মামলায় জয় লাভ: সম্ভব যদি গ্রহণ শুরুর সময় বগলামুখী যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গোটা হলুদ, হলুদ ফুল আর কেশর দিয়ে পুজো করার পর ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। একই সঙ্গে পুজোর পর একটি তিনমুখী রুদ্রাক্ষও যন্ত্রের সামনে রাখতে হবে। গ্রহণ যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ গোটা হলুদের মালা হাতে নিয়ে এই মন্ত্র জপ করতে হবে: 'ওঁ হ্রীং বগলামুখী সর্বদুষ্টানাং বাচং মুখং পদং স্তংভয় জিহ্বা কীলয় বুদ্ধি বিনাশায় হ্রীং ওঁ স্বাহা
তন্ত্রের ভুল ব্যবহার থেকে মুক্তি: পেতে চাইলে গ্রহণের সময় একটি হলুদ, বড়ো, দাগহীন পাতিলেবু নিয়ে নিজের শরীরের ওপর সাতবার বুলিয়ে বা ঘুরিয়ে লেবুটিকে চার টুকরোয় কেটে ফেলুন। এবার সেই চারটি টুকরো চৌরাস্তার চার দিকে ফেলে দিয়ে আসুন।
র্গামন্ত্র :- ভূ-লোকে রিদ্ধি-সিদ্ধি লাভের জন্য একটি মহাকুঞ্জিকা রচনা করেন মহাগৌরী পার্বতী। তিনি বলেন, তাঁর যে ভক্ত তাঁকে স্মরণ করে এই মন্ত্র উচ্চারণ করবে, সে এই সংসারে জীবন সুখ-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করবে। ধন-ধান্য এবং সমৃদ্ধির অভাব হবে না। এটি একটি গুপ্তমন্ত্র। এই মন্ত্র পাঠ করলে মারণ, মোহন, বশীকরণ এবং উচ্চাটন ইত্যাদি উদ্দেশের সিদ্ধি হয়। এই মন্ত্রটি হল-- ওম এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে। ওম গ্লৌং হুং ক্লীং জুং সঃ জ্বালয় জ্বালয় জ্বল জ্বল প্রজ্বল প্রজ্বল এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে জ্বল হং সং লং ক্ষং ফট্ স্বাহা।
সুশীল এবং বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন স্ত্রীর প্রাপ্তির জন্য :- ভার্য্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্। রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।। তারিণি দুর্গসংসার-সাগরস্যাচলোদ্ভবে। রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।। কোনও বিপত্তির হাত থেকে বাঁচতে :- শূলেন পাহি নো দেবী পাহি খড়গেন চাম্বিকো। ঘণ্টাস্বনেন নঃ পাহি চাপজ্যানিঃস্বনেন চ।। প্রসন্নতা প্রাপ্তির জন্য :- প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবী বিশ্ববার্তিহারিণি। ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব।।
কে না জানে, জীবন ইক্যুয়ালটু রকমারি সমস্যা! তা বলে লাগাতার সমস্যায় ভুগতে কার ভালো লাগে! অনেকেই জানেন না, যেমন হরেক কিসিমের সমস্যা আছে তেমনি তার নানা সমাধানও রয়েছে। আর সে সবই হয় মন্ত্রগুণে। তবে মন্ত্রে বিশ্বাস রাখতে হবে। শান্ত মনে জপ করতে হবে। সঙ্গে ধূপ জ্বালাতে পারলে আরও ভালো। তবেই ফল মিলবে। এবং মন শুদ্ধ করতে প্রথমে আরাধ্য দেবতা, গণেশ, গুরুদেব বা মহাদেব-কে স্মরণ করতে হবে।
এমনও হয়, দোষ না করেও আপনি দোষের ভাগীদার হয়ে যান। আর অকারণে লাঞ্ছিত হওয়ায় মন অস্থির হয়ে ওঠে। এই অসুবিধে দূর করতে জপ করুন 'ওঁ হ্রিং ঘৃণীঃ সূর্যায় আদিত্য শ্রী/ ওঁ হ্রিং জূং সঃ ক্লীং ক্লীং ক্লীং'। কোনও গ্রহের প্রভাবে সব সময় ভয় বা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। এমন আশঙ্কাও হয় যে, ঘর থেকে বের হলেই ভয়ানক ক্ষতি হবে। তখন ঈশ্বরকে স্মরণ করে জপ করবেন 'ওঁ জূং সঃ (নিজের পুরো নাম) পালয় পালয় সঃ জূং ওঁ ওঁ ওঁ' কর্মক্ষেত্রে উন্নতি চাইলে জপ করুন, 'ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ/ তত্সবিতুর বরেণ্যং/ ভর্গো দেবস্য ধীমহি/ ধিয়ো যোনঃ প্রচোদয়াত্ ক্লীং ক্লীং ক্লীং'
হতে হতে কোনও হওয়া কাজ মাঝপথে আটকে গেলে জপ করুন, 'দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবি পরং সুখম/ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি'। পরীক্ষায় ভালো ফল করতে চাইলে এই মন্ত্র বলুন, 'এং হ্রিং এং/ বিদ্যাবন্তং যশস্বন্তং লক্ষীবন্তঞ্চ মাং কুরু/ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি এং এং এং'।
১৯৭৭ সাল। কোলকাতার হাতিবাগানের তান্ত্রিকাচার্য মনসারাম ভট্টাচার্য্য জ্যোতিঃশাস্ত্রী ওভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তীব্র সমালোচনা করেছিলেন অন্যান্য আচারভুক্ত বিভিন্ন তান্ত্রিক বা তন্ত্র-সাধকদের ক্রিয়াকলাপের। ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘ওরা ব্যভিচারী। ভূত-প্রেত-পিশাচের দল।’
সব শুনে হো হো করে হেসেছিলেন কালীঘাটের কালী মন্দিরের কাছে আস্তানা নেওয়া রামপুরহাটের কালীকৃষ্ণ বাবা। বলেছিলেন, “ঠিকই তো, আমরা স্বয়ং শিবের সাক্ষাৎ ভূতপ্রেত তো বটেই! শ্মশানে-মশানে ঘুরি, আর ওই পঞ্চতত্ত্বই বলুন আর পঞ্চমকারই বলুন, আমরা ওতেই শক্তিসাধনা করি। আমরাও অভীষ্টে পৌঁছুই, আমরাও সিদ্ধিলাভ করি।”
হাতিবাগানের মনসারাম তান্ত্রিকাচার্য ছিলেন গৃহী মানুষ। বিয়ে-থা করেছিলেন, ঘরসংসারও ছিল। তিনি হাতিবাগানের সুবিখ্যাত টোলের একজন কর্মকর্তাও ছিলেন। সাধনার একটা স্তরে কাটাতে হয়েছিল তারাপীঠে। মহাশক্তি-মহাকালী তারাপীঠের তারামায়ের দর্শনও নাকি তিনি পেয়েছিলেন। শুভ্র বস্ত্র পরিহিত, গলায় মুক্তো আর রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে ছোট্ট সিঁদুর-চন্দনের ফোঁটা, নিখুঁতভাবে কামানো গোঁফ-দাড়ি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অতি বিনয়ী ওই তান্ত্রিকাচার্য সাধনালব্ধ ক্ষমতাকে সে সময়ে নিয়োগ করেছিলেন মানবাত্মার কল্যাণে। প্রতিদিন জমে যেত বহু মানুষের ভীড়।
তান্ত্রিকাচার্য মনসারাম বা কালীঘাটের কালীকৃষ্ণ বাবা উভয়ই কিন্তু ছিলেন মূলত বামাচারী শাক্ত তান্ত্রিক। বীরাচার অথবা বীরসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন এবং আরও নাকি এগুচ্ছিলেন। অথচ যেন ছিলেন বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। ওঁদেরই কথায় বুঝেছিলাম, একজন ছিলেন শিবোক্ত ‘সদাগম’ পথের পথিক, আরেকজন শিব নিষিদ্ধ ‘অসদাগম’ পথের। সদাগম, অসদাগম ব্যাপারটা সম্বন্ধে তন্ত্রবেত্তাদের কাছে জেনেছিলাম, স্বয়ং শিবের মুখ থেকেই নাকি আগম শাস্ত্র নিঃসৃত হয়েছিল। ওই আগমের আবার দুটো ভাগ। সদাগম, অসদাগম। পঞ্চতত্ত্বে দেবতার পুজো করাই নাকি অসদাগম। জেনেছিলাম, আগম সংহিতায় শিব নিজ-মুখেই ওই পঞ্চতত্ত্ব বা পঞ্চমকারে পুজো-পদ্ধতির নিন্দা করেছিলেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, কলিযুগে মানুষ বর্ণাশ্রমধর্ম ভুলে গিয়ে রাজসিক ও তামসিকের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তিনি নাকি আরও বলেছিলেন, ওই সব নিষিদ্ধ জিনিস দিয়ে যারা তাঁর পুজো করবে তারা ভূত-প্রেত-পিশাচে পরিণত হবে।তাহলে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চমকার– অর্থাৎ মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুনে পুজো করাটা শিব নিষিদ্ধ। অথচ এমন কোনো নিদর্শন নেই যাতে বোঝা যায় কোনো বামাচারী তান্ত্রিক পঞ্চমকার ব্যতিরেকে শক্তিসাধনা করেছেন বা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। অমন যে তান্ত্রিক শিরোমণি তারাপীঠের বামাখ্যাপা– যাঁকে অনেকেই সাধারণভাবে মনে করতেন দক্ষিণাচারী আকুমার ব্রহ্মচারী; তিনিও প্রখ্যাত পরিব্রাজক শিল্পী প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন
আধুনিক অনেক পণ্ডিত মনে করেন, শিবোক্ত ওই ‘আগম’ এবং তার সদাগম, অসদাগম ভাগ– এগুলো সব ব্রাহ্মণ্য চক্রান্তেরই ফল। কেননা, যেহেতু তন্ত্রে জাতপাতের কোনো বালাই ছিল না; ছিল না বর্ণাশ্রমের কোনো অস্তিত্ব– যা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পক্ষে চূড়ান্ত ক্ষতিকারক হয়ে উঠেছিল। তাই প্রয়োজন হয়েছিল স্বয়ং শিবকে খাড়া করে আগম সংহিতা জাতীয় কিছু শাস্ত্র রচনার। লক্ষণীয় ব্যপারটি হ’ল, তন্ত্র শিবোক্ত হলেও– মূল তন্ত্রে কিন্তু আবার বলা হয়েছে শক্তি ব্যতিরেকে শিব শুধুই একটি শব।
যাহোক, সাতের দশকে যখন এই বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম তখন লক্ষ্য করেছিলাম, সে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চক্রান্তেই হোক, বা আর যাই হোক, তদানীন্তন সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে তন্ত্রের সদাগম এবং অসদাগম ভাগাভাগিটা কিন্তু তখনকার তান্ত্রিকরা বেশ ধরে বসেছিলেন।
সে সময়ের তান্ত্রিকরা বিধি-নিষেধ, উগ্রতা এবং শিক্ষাগত মর্যাদা অনুযায়ী নিজেদের সদাগমী এবং অসদাগমীতে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। তবে বেশীরভাগ উগ্র তান্ত্রিকই কিন্তু প্রকাশ্যে নিজেদের অসদাগমী বলতে রাজি ছিলেন না। কেননা, অসদাগমের আভিধানিক অর্থটা নিতান্তই হেয় প্রতিপন্ন করত।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ভক্ত-শিষ্যদের উপদেশ দিতে গিয়ে বার বার বলেছিলেন, “বীরভাব ভালো না। নেড়া-নেড়ী, ভৈরব-ভৈরবীদের বীরভাব। অর্থাৎ, প্রকৃতিকে স্ত্রীরূপে দেখা আর রমণ দ্বারা প্রসন্ন করা। এ ভাবে প্রায়ই পতন আছে।”শুধু এই নয়, শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, নানা পথেই তো বাড়িতে ঢোকা যায়। কেউ ঢোকে সদর পথে, কেউ ঢোকে পায়খানার পথে। সব পথেই সিদ্ধিলাভ করা যায়। কিন্তু এখন ওই বীরভাব মোটেই ভালো না। বড় কঠিন। শ্রীরামকৃষ্ণের এই উপলব্ধি অবশ্যই ছিল তাঁর সাধনা লব্ধ। মূলত তিনি ছিলেন বৈদান্তিক-দক্ষিণাচারী; সন্তান-ভাবে ভাবিত আকুমার ব্রহ্মচারী। তথাপি তাঁকেও বামাচারে সাধনা করতে হয়েছিল, ভৈরবী নিয়ে চক্রে বসতে হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, “একদিন দেখি, ব্রাহ্মণী যোগেশ্বরী ভৈরবী নিশাভাগে কোথা হইতে এক পূর্ণ যৌবনা সুন্দরী রমণীকে ডাকিয়া আনিয়াছে এবং পূজার আয়োজন করিয়া দেবীর আসনে তাহাকে বিবস্ত্র করিয়া উপবেশন করাইয়া আমাকে বলিতেছে, ‘বাবা, ইঁহাকে দেবীবুদ্ধিতে পূজা কর’। পূজা সাঙ্গ হইলে বলিল, ‘বাবা, সাক্ষাৎ জগজ্জননী জ্ঞানে ইঁহার ক্রোড়ে বসিয়া তন্ময় চিত্তে জপ কর।”শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মতো অতবড় সাধককেও ওই অবস্থাতে যে কী ভয়াবহ-যন্ত্রণাদায়ক মানসিকতায় ভুগতে হয়েছিল তা তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এবং ওই ‘আনন্দ আসনে’ বসে তাঁর স্বকীয় ক্ষমতায় মাতৃনাম জপ করতে করতে মুহূর্তেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব বর্তমান কালের মানুষকে আর্থ-সামাজিক অবস্থার গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী বামাচার তথা বীরভাব-এ ভাবিত হতে প্রতিনিয়ত বাধা দিতেন। তারাপীঠের তারামায়ের সন্তান বামাখ্যাপা কিংবা এই লেখার প্রথম অংশে উল্লিখিত পরিব্রাজক প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়ের দেখা কামাখ্যার উমাপতি বাবাদের মতো বামাচারে সিদ্ধ তান্ত্রিকরাও চারিদিকের স্থূল-মানসিকতা বিশিষ্ট ক্ষমতালোভী তথাকথিত তান্ত্রিকদের ভালো চোখে দেখতেন না। কিন্তু হলে কী হবে? আদি এবং প্রকৃত তান্ত্রিকাচার বহির্ভূত পঞ্চমকারে ভরাডুবি করা বিকৃত রুচির স্বঘোষিত তান্ত্রিকদের সংখ্যা কিন্তু বেড়েই চলেছে; সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে সম্মোহন, মারণ, বশীকরণ ইত্যাদিতে পারদর্শী হিসেবে বহু রকমের আচার্য অথবা অমুক শাস্ত্রী, তমুক শাস্ত্রীর সংখ্যা।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছিলেন, “বাবা, তন্ত্র-জগৎটাকে বেশী ঘাঁটতে যেওনা। এর আগা বা গোড়া কিছুই বুঝবে না। হাজার হাজার বছর ধরে বহু ধর্মের প্রভাবে মূল তন্ত্র তো আর তন্ত্রই নেই– বহু ডালপালা গজিয়ে গেছে। এই ধর না, আমি তোমাকে শিবোক্ত আগম শাস্ত্র থেকে কিছু নিয়ম-নীতি বললাম– ঠিক তেমনি নিয়ম-নীতি তুমি পাবে যামল, ডামর– এগুলো থেকেও; পাবে সেগুলোরও আরও বহু বহু ভাগ– বুঝলে? খুব জটিল ব্যাপার।”
তন্ত্র বিদ্যা একটি বিশাল আলোচনা। যার শুরু হয়তো আমরা কিছুটা জানি তবে শেষ কোথায় টা আমরা জানি না। তাই নির্দিষ্ট শব্দের মধ্যে আলোচনা করাও সম্ভব নয়। পরে যদি কোনোদিন সুযোগ পাই তাহলে এই বিষয়ে আরো আলোচনা করা যাবে। লং পশুভাবেন মন্ত্রসিদ্ধির্ভবেন্নৃনাং।।”
তথ্য সূত্র : শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ : সাধক ভাব
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম কথিত : তৃতীয় খণ্ড
অঘোরনাথের তন্ত্রকথা
তন্ত্র , তাত্ত্বিক ও দেহতত্ববাদ
...
Comments
Post a Comment