| অচেনা লালবাজার - বসুন্ধরা বসু || আত্মজ - July |

 বিপ্লবী বারীন ঘোষ,হেমচন্দ্র দাসের অনেক অনুরোধ,অনেক বোঝানোর পরে অবশেষে সে নিরস্ত হল কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে মুজফফরপুরের যাওয়ার বদলে বাবাকে দেখতে গেলেন সিলেট৷

অত্যাচারী ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ডকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে তাঁর বদলে গেলেন অন্য আর এক বিপ্লবী৷
—কী?
হ্যাঁ স্যার ছুটে এসে ধাক্কা মেরেছে৷
কি সাহস!
একবার ভেবে দেখুন৷
কাস্টডি করে দেবো?
কিংসফোর্ড অবশ্য তাঁকে দেখে বললেন
He's just child!
তবে কিংসফোর্ড সাহেবের কড়া আদেশ,
একে সবার সামনে পনেরো ঘা বেত মেরে তবেই যেন ছাড়া হয়৷
বিচারকের আদেশ পালন করতে আজ্ঞাবহ ব্রিটিশ পুলিশ সুশীল সেন কে তিনতলা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এল নীচে৷
বিচারকের আদেশ পালিত হচ্ছে,
লালবাজার চত্বরে বছর পনেরোর কিশোর সুশীল সেনের পিঠে পড়ছে একের পর এক বেতের ঘা৷যত জোরে সুশীলের পিঠে বেত পড়ছে তত জোরেই সুশীল স্লোগান দিচ্ছেন 'বন্দে মাতরম'৷
এক কিশোরকে এভাবে বেত্রাঘাতের পাশবিকতায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন দেশের আবালবৃদ্ধ বনিতা৷
বিপ্লবীরাও ক্ষোভে,ক্রোধে ফুঁসছেন৷
এসব মেনে নেওয়া যাবে না৷
একটা বাচ্চা ছেলেকে এভাবে সবার সামনে নির্দয় ভাবে বেত পেটা!
কিছুতেই মেনে নেওয়া যাবে না৷
বিপ্লবীদের গুপ্ত আলোচনায় শুধু একটাই কথা কিংসফোর্ডকে সমুচিত শিক্ষা দিতেই হবে৷
বিপ্লবীদের কাছে কিংসফোর্ড তখন 'কসাই কাজি',হিট লিস্টে তাঁর নাম একদম উপরের দিকে৷
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত মানুষ সুশীল সেনের পিঠে নির্দয় ভাবে বেত্রাঘাতের ঘটনায় অতিশয় ক্ষুব্ধ, চরমপন্থীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন উচিৎ শিক্ষা পাবে অত্যাচারী কিংসফোর্ড৷
কিশোর সুশীল সেন অবশ্য বিপ্লবীদের কাছে রাতারাতি নায়কের মর্যাদা পাচ্ছেন ৷
কলেজ স্কোয়ারে তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনায় কিশোর সুশীলকে দেখতে উপচে পড়া ভিড়,কারন ইংরেজ পুলিশ আধিকারিক E B Huey-এর লাঠিচার্জের সময় সুশীল তাঁকে পাল্টা কয়েক ঘা দিয়েছেন৷এমন অকুতোভয়ের দেশপ্রেমিক কিশোর কে দেখতে জনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক৷
বিপ্লবীদের মুখে মুখে ঘুরত সেইসময় একটি গান বেত্রাঘাত নিয়ে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ লিখেছিলেন ,
প্রবল
(আমার) যায় যাবে জীবন চ'লে আমায়—
বেত মেরে কি 'মা' ভোলাবে' ?
আমি কি মা'র সেই ছেলে?
চিফ প্রেসিডেন্সি আদালতে বিচারকের আসনে বসতেন ট্রিনিটি কলেজের পড়ুয়া উচ্চশিক্ষিত চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট ডগলাম হোলিনশেড কিংসফোর্ড৷
দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের জন্য
তাঁর নিষ্ঠুরতা ছিল মাত্রাহীন,ভয়ঙ্কর৷
'বন্দে মাতরম' পত্রিকার বিভিন্ন লেখায় তখন জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের সৌরভ,উদ্দীপনা, প্রতিটি লেখায় জনমানসে প্রবলভাবে প্রভাব পড়ছে৷
ব্রিটিশরা ভীত,দেশ তখনও কাঙ্খিত স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি,ইউনিয়ন জ্যাক কে সরিয়ে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার স্থান পেতে ঢের দেরি৷
যুগান্তর পত্রিকায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে দুটি লেখা লিখে
কিংসফোর্ডের বিচারে স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের জেল হল এক বছর৷
মামলা হল 'বন্দে মাতরম'পত্রিকার বিরুদ্ধেও৷
মামলা সেইসময় নাটকীয় মোড় নিল যখন পত্রিকার সম্পাদক অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করলেন বিপিনচন্দ্র পাল৷
শুনানির সেইসব দিনে আদালত চত্বরে জনস্রোত,স্বদেশিদের স্লোগান উঠত মুহুমুহু৷
বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষের জনস্রোত সঠিকভাবে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে
ইংরেজ পুলিশ নির্বিচারে লাঠিচার্জ শুরু করল সাধারনের উপর৷
কিন্তু ২৬আগস্ট,১৯০৭ দিনটা ছিল একটু আলাদা রকমের৷
মামলার শুনানি শুরু হয়েছে,বাইরে তখন মুহুমুহু 'বন্দে-মাতরম' স্লোগান দিচ্ছেন জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিপ্লবী থেকে সাধারন মানুষ৷
ইনেস্পেকটর E B Huey -এর নেতৃত্বে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল সাধারন মানুষের উপর লাঠিচার্জ শুরু করেছে ব্রিটিশের পুলিশ, কিন্তু বছর পনেরোর এক কিশোরের পাল্টা মার হজম করতে হবে স্বপ্নেও ভাবেন নি Huey সাহেব,পুলিশের লাঠিচার্জের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল বছর পনেরোর রোগাসোগা চেহারার সুশীল সেন,পাল্টা হাত চালিয়ে বেশ কয়েক ঘা দিয়ে দিলেন ইনেস্পেকটর সাহেব কে৷
অসম লড়াই,
আশপাশের ব্রিটিশ পুলিশ কার্যত ধরে-বেঁধে সুশীলকে নিয়ে গেলো কিংসফোর্ডের এজলাসে৷
তারপর কিংসফোর্ডের সেই বেত্রাঘাতের আদেশ আর সুশীলের মুখে দৃপ্ত কণ্ঠে মুখরিত 'বন্দে মাতরম' স্লোগান৷
বিপ্লবী সুশীলের জন্ম শিলংয়ে,১৮৯২ সালে, বাবা কৈলাশচন্দ্র সেন আই জি কারা কার্যালয়ের করণিক৷
মেধাবী সুশীল স্কুলে ডবল প্রোমোশন পেয়েছিলেন৷
১৯০৫সালে মাত্র ১৩বছর বয়সে যোগ দিলেন সিলেটে জ্ঞানেন্দ্রনাথ ধরের গুপ্ত সংগঠনে৷
পরে বিপিনচন্দ্র পালের বক্তৃতা শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে চলে এলেন কলকাতায়৷
বিপ্লবীরা ধারনা করছিলেন কিংসফোর্ড হয়ত কলকাতা থেকে বদলি হবে!তার আগে তাঁকে হত্যা করতেই হবে৷
কিংসফোর্ডের বাসস্থান সরেজমিনে একাধিকবার দেখে আসার দায়িত্ব দেওয়া হল অসম সাহসী সুশীলকেই৷
সম্ভাব্য বদলির আগেই কিংসফোর্ড কে নিকেশ করে ফেলতে মরিয়া বিপ্লবীরা৷
জল্পনা সঠিক প্রমানিত হল বদলির আদেশ পেলেন কিংসফোর্ড,চাকরির নতুন গন্তব্য মুজফফরপুর৷
বিপ্লবীদের দুর্ভাগ্য বদলির সময় পাওয়া অন্য উপহারের সঙ্গে তাঁকে হত্যা করার জন্য বিপ্লবীদের প্রেরিত বই-বোমা স্থান পেলো সাহেবের বাংলোর কাছে এক আস্তাবলে৷
আয়ুবৃদ্ধিই ঘটেছিল কিংসফোর্ডের৷
বইপ্রেমী অথচ বিপ্লবীদের প্রতি নিষ্ঠুর কিংসফোর্ড সময়ের অভাবে বিপ্লবীদের প্রেরিত আইনের মোটা বই যেটি আদপে 'বই-বোমা' সময়ের অভাবে সেটি পড়ার সময় পেলেন না,বেঁচে গেলেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে৷
তবে প্রাথমিক ভাবে হতোদ্যম হলেও বিপ্লবীদের সিদ্ধান্ত কিংসফোর্ডের বিচার হবেই,তাদের হিট লিষ্টে তাঁর নাম, মুজফফরপুরে গিয়ে তাঁকে হত্যা করা হবে৷
বারীন ঘোষ কিংসফোর্ড কে হত্যার জন্য নির্বাচন করলেন দুই ঘাতক৷একজন প্রফুল্ল চাকী,অপরজন পুলিশ ইনেস্পেকটর কে কোর্ট চত্বরে পাল্টা কয়েক ঘা দেওয়া সুশীল সেন৷
দূর্গাদাস সেন ও দীনেশচন্দ্র রায় ছদ্মনামে সুশীল ও প্রফুল্ল সরেজমিনে ঘুরে এলেন মুজফফরপুর৷খুঁটিয়ে দেখে নিলেন কিংসফোর্ডের বাংলোর অবস্থান৷সাহেবের সারাদিনের গতিবিধির প্রচুর তথ্য জোগাড় করলেন৷
এদিকে বিধি বাম কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে মুজফফরপুর রওনা হবার কয়েকদিন আগে খবর এল সুশীল সেনের বাবা গুরুতর অসুস্থ সিলেটে৷তখন তিনি প্রায় মৃত্যুশয্যায়৷
ওদিকে বিপ্লবী নেতাদের কাছে সুশীলের আবেদন তিনি কিংসফোর্ডকে হত্যা করেই তবে যাবেন সিলেট৷
বারীন ঘোষ,হেমচন্দ্র দাস অনেক বোঝানোর পরে নিরস্ত করা গেল সুশীলকে,বাবাকে দেখতে তাঁকে পাঠানো হল সিলেটে৷
কিংসফোর্ড হত্যায় সুশীলের পরিবর্তে গেলেন অন্য এক তরুণ তাঁর নাম শহিদ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু৷
সুশীল অবশ্য থেমে থাকলেন না উচ্চশিক্ষায় মন দিলেন৷
ম্যাট্রিকে চর্তূদশ স্থান অধিকার করলেন,রসায়নে স্বর্ণপদক সহ স্নাতক৷প্রেসিডেন্সিতে পড়তে পড়তে আলাপ যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ বাঘা যতীনের সঙ্গে৷আবার সেই এক ব্রত দেশকে স্বাধীন করতে হবে,প্রয়োজনে আত্মবলিদান৷
বীরের মত মৃত্যুবরন করেছিলেন এক সশস্ত্র অভিযানে৷
পুলিশের চক্রব্যুহে আটকে পড়েছেন,গুলি লেগেছে দু'পায়ে সহযোদ্ধাদের বুঝিয়েছিলেন তারা যেন পালায়,তবে আগামীদিনে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার রসদ মজুত থাকবে৷ব্রিটিশ পুলিশের বুলেট নয় বিপ্লবী সুশীল সেনের নির্দেশেই সতীর্থদের বুলেটেই তিনি জীবন দিয়েছেন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে৷
পরিকল্পনা মত সুশীলের দেহ খন্ডিত করে বিভিন্ন জায়গায় পুঁতে দিয়েছিলেন সহযোদ্ধারা,খুঁজে পায়নি ব্রিটিশের পুলিশ৷
দেশ স্বাধীন হয়েছে,সত্তরের বেশি বছর অতিক্রান্ত আমরা কত জন মনে রেখেছি বীর বিপ্লবী সুশীল সেনের কথা?
মনে কী রেখেছি তাঁর ত্যাগের খতিয়ান?
পরবর্তী প্রজন্মকে এই ইতিহাস জানানোর দায় আমাদের কতটা ত্যাগের মূল্যে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা৷
তথ্যঋণ -অচেনা লালবাজার



Comments

Popular Posts