। সারারাত কেটে যায় এইসব ভেবে। । পর্ব - 2।
'হঠাৎ তোমার সাথে কলকাতার সে এক সন্ধ্যায়
উনিশশো চুয়াল্লিশে দেখা হল—কত লোক যায়
ট্রাম বাস ট্যাক্সি মোটর জীপ হেঁকে
যাদের হৃদয়ে কথা বেশি হাতে কাজ কম—তাদের অনেকে
পায়ে হেঁটে চলে যায়।'
বিনয় ঘোষ (কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত )
কলকাতা। আমার শহর নয় ।আমি এখানে জন্মেছি তবে এই শহরকে ভালোবাসতে সময় লেগেছে অনেক। একটা শহরকে তখনি ভালোবাসা যায় যখন সেই শহরের কোনো মানুষের সাথে প্রেম করা যায়।
কলকাতাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক কথাই ভিড় করে আসছে। এলোমেলো ভাবে অবশ্যই। ওই ভিড়ের যা ধর্ম আর কী! বড়-ছোট-প্রধান-অপ্রধান আলাদা ভাবে বোঝা যায় না।
কলকাতায় প্রেম নাকি হেঁটে বেড়ায় মাইলের পর মাইল, মনের আনন্দে। কত অজানা মন্দিরের অলিগলি, গুরুদ্বারের শান্ত পাঁচিল অথবা গির্জার নিরালা সেমেট্রি কিংবা জুম্মা পীরের দরগা সাক্ষী থেকে যায় প্রেমের কলকাতার। ভালবাসার-মন্দবাসার কলকাতার। শহুরে হাওয়ায়, নীরব প্রেমের পথচলায় সঙ্গী হয় দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর, কালীমন্দিরের আরতির ঘণ্টাধ্বনি যুগপতভাবে। এই কলকাতা শহরের বড় রাস্তা, অলিগলি আর ইতিহাসমাখা সব ভবনের দিকে তাকালে জীবনানন্দের কথা মনে পড়ে।
'ধর্মতলা বউবাজারের উত্তরদিকে টালা বাজার পর্যন্ত যে কলকাতা গিয়েছে, এটা সে কলকাতা নয়—চৌরঙ্গীর কলকাতাও নয়—এটা কালীঘাট পেরিয়ে ঢাকুরিয়া টালিগঞ্জ যাদবপুর বালিগঞ্জের এলাকায়। সোমনাথ বারো বছর আগে কলকাতায় এসেছিল মেছোবাজারে ঝামাপুকুর লেনে আরো কোথায় কোথায় যেন—ওইদিকে। মাঝে মাঝে সে চৌরঙ্গি অব্দি বেরিয়ে আসত বটে, তারপরে জগুবাবুর বাজারের চেহারা পর্যন্ত তার চেনা ছিল—এর পরবর্তী কলকাতা সম্পর্কে তার কোনো কৌতূহল ছিল না। এবার ভালো করে দেখেছিল সব ঘুরে ঘুরে। রসা রোড—টালিগঞ্জের দিকে চলে গিয়েছে—ট্রামে যাওয়া যায়—হেঁটে যাওয়া যায়—ট্রামে খানিকদূর গিয়ে তারপরে হেঁটে চলার ভিতরেই মন নাড়া পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে। এদিকে রাসবিহারী এভিনিউ—বালিগঞ্জ স্টেশন যাদবপুর—আবার ফিরে এসে সাদার্ন এভিনিউ—এই পথ ধরে আবার ঘুরে টালিগঞ্জের " .......
এটুকু বর্ণনায় যেসব রাস্তাঘাটের কথা তিনি লিখেছেন, তাঁর সবই তাঁর নিজের জীবনী। বস্তুত জীবনানন্দের সব গল্প ও উপন্যাসের নায়ক তিনি নিজেই। এই গল্পের সোমনাথও তা-ই।
১৯৪৬ সালের ৮ জুলাই বরিশাল থেকে কলকাতায় যাওয়ার পর ছোট ভাই অশোকানন্দের বাসায় বসে গল্পটি লেখা। এখানে যেসব এলাকার কথা লিখেছেন, সেসব জায়গায়ই তিনি জীবনের কোনো না কোনো সময় কাটিয়েছেন।
যেমন লিখেছেন, কলকাতায় প্রথম আসার পর সোমনাথ (মূলত জীবনানন্দ) মেছোবাজারে ঝামাপুকুর লেনে আরও কোথায় কোথায় যেন—ওই দিকে।
জীবনানন্দ কলকাতা শহরকে নানাভাবে দেখেছেন।
'ভিখিরি' শিরোনামের একটি কবিতার শুরুটা এ রকম:
'একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরিটোলায়
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—
তবে আমি হেঁটে চলে যাব মানে মানে।'
দুই লাইন পরে আবার লিখছেন:
'একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—
তাহলে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা।'
ক্লিন্টন বি সিলি (অনন্য জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ১৮৭) বলছেন, 'এই মর্মভেদী ছোট কবিতাটা দিয়ে মানবতাবাদী জীবনানন্দকে সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায়। তিনি ভিখারিদের দেখেন বাড়িয়ে দেওয়া হাত, চোখে পড়ার জন্য গলা লম্বা করে দিচ্ছে। অথচ তিনি কল্পনা করেছিলেন বনলতা সেনকে, আর এখন দেখছেন সত্যিকারের মানুষ।'
সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (জীবনানন্দর কোলকাতা, জীবনানন্দ স্মৃতি) ভাষায়,
'কলকাতার গভীরে যে কলকাতা, যার মাথার উপরে স্কাইলাইট আর সেখানে আকাশে পাখিরা পরস্পর কথা বলে, সেই কলকাতাকেই জীবনানন্দ ভালোবেসেছেন। তারই অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতরে অনন্ত মৃত্যুর মতো তিনি মিশে থাকতে চেয়েছেন। শরীরে তারই মাটির গন্ধ মেখে, জলের গন্ধ মেখে তিন মগ্ন হয়েছেন।
আমার কাছে কিন্তু সেই মারাদোনার বিশ্বকাপ জেতার পরে যে-উৎসবের শহর, সেই কলকাতা আজও অমলিন। তার চেয়ে বেশি জৌলুস অন্তত আমার চোখে কলকাতার কোনও দিনও হবে না। আমার কাছে কলকাতা সেই কলকাতাতেই আছে।
photo credits : GOOGLE
Comments
Post a Comment